আজ ‘মানসী’ আশ্রমের প্রতিষ্ঠা দিবস। বাবা মা-র একমাত্র সন্তান হিসাবে পৈতৃক সূত্রে যেটুকু অর্থ পেয়েছেন, সবই সুতপা সেন রূপান্তরকামী মানুষজনের আশ্রয় ‘মানসী’ আশ্রমের জন্য দান করেন। বর্তমানে রূপান্তরকামীদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তারা সামাজিক জীবনের স্বীকৃতি পেয়ে নিজের নিজের জীবিকার পথও খুঁজে নিচ্ছে।
আজকের দিনটা বিভিন্ন রূপান্তরকামী মানুষজনের সঙ্গেই কাটে সুতপা সেনের। এনজিও করার সূত্রে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাদের সকলকে নিজেদের সাধ্য মতো জীবকা নির্বাচনে উৎসাহ দেন ও স্থায়ী বাসস্থানের আশ্বাস দেন সুতপা। দিদি হিসাবে তাদের সকলের কাছে বেশ জনপ্রিয় তিনি। মানসিক দৃঢ়তা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও উদ্যোগ না থাকলে ‘মানসী’ গড়ে উঠত না। এজন্য কিছু সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তা সুতপা পেয়েছেন।
“মানসী গড়ে তোলার কাজে আপনি কেন সংকল্প নেন?” স্থানীয় সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে সুতপা হেসে বলেন, “ জীবন তো শুধু নিজের জন্য নয়। পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যও ভাবা উচিত - এই সংকল্পেই এগিয়েছিলাম।”
সমবেত সকলে করতালি দিয়ে সাধুবাদ জানান তাঁকে।
সুতপা সেনের পঁচিশ বছর আগের স্মৃতির পাতাগুলো আজও অমলিন। সুতপার স্কুলের বান্ধবী মানসী হরমোনের পরিবর্তন ঘটিয়ে পুরুষ হতে চেয়েছিল। কলেজে পড়তে সে দৃঢ় ভাবে সুতপাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল। স্কুল থেকেই মানসী সুতপার সব থেকে কাছের বান্ধবী ছিল, যাকে সুতপা মনের কথা না বলে থাকতে পারতেন না। তাদের মান অভিমান খুনসুটি ধীরে ধীরে প্রেমের আকার নেয়। কলেজে পড়তে মানসীর বাইকে করে শহর ছাড়িয়ে সুতপা গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন। প্রকৃতির সান্নিধ্যে দুটি মানুষ মানসিক ভাবে আরও কাছাকাছি হত। খালের ধারে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মানসীর কাঁধে মাথা রেখে সুতপা স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে যেতেন।
মানসীর পুরুষসুলভ ভাবভঙ্গী ও পোশাক দেখে তার সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করেছিলেন সুতপার বাবা মা। বি.এ পাশ করে এম.এ পড়তে চেয়েছিলেন সুতপা। তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও বাড়ি থেকে তখন তাঁর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। গভীর দুঃখে মানসী সুতপার বিয়ের দিনই সুইসাইড করে-এই খবরটা বিয়ের কদিন পর সুতপা পান। মানসিক ভাবে ভীষণই ভেঙে পড়েছিলেন।
অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে পারেননি সুতপা। ছোট থেকে যে সংস্কার ও বিশ্বাসে মানুষ, তার কিছুই যেন শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে মিলত না। এমনকি তাঁর স্বামীও তাঁকে বোঝেননি। তাই দু বছরের মাথায় ডিভোর্স-এর সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেননি সুতপা। তারপর থেকেই তিনি বেছে নেন এনজিও-র কাজ। মানুষের উন্নয়নকে ব্রত করে এভাবেই শুরু হয় সুতপার দীর্ঘ পথ চলা।